২০২৪ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দুইজন অসাধারণ বিজ্ঞানী— জন হপফিল্ড এবং জিওফ্রি হিন্টন। তবে মজার ব্যাপার হলো, তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আর মেশিন লার্নিং এর উন্নতিতে বিশাল অবদান রেখেছেন, যেটা শুনে অনেকের প্রশ্ন জাগতেই পারে—এটা তো কম্পিউটার সায়েন্সের বিষয়, তাহলে ফিজিক্সের নোবেল পুরস্কার কেন? চলুন সেই রহস্যটাই আজ খুলি!
আমরা ছোটবেলায় পদার্থবিজ্ঞানে শিখেছি, ফিজিক্স শুধু গ্র্যাভিটি বা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা নিয়ে কাজ করে না। ফিজিক্সের কাজ মূলত প্রকৃতির নিয়ম বোঝা। আর এই নিয়ম থেকে কতরকমের জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা যায়, তারই এক উদাহরণ হপফিল্ড এবং হিন্টনের কাজ।
শুরুতেই জানি জন হপফিল্ডের মস্তিষ্কের মতো নেটওয়ার্ক নিয়েঃ
জন হপফিল্ড ছিলেন একেবারে অন্যরকম চিন্তার মানুষ। ১৯৮০-এর দশকে, তিনি মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর কাজ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। কিভাবে এতো বিলিয়ন নিউরন একসাথে কাজ করে জটিল তথ্য মনে রাখতে পারে? ঠিক এই চিন্তাটাই তাকে হপফিল্ড নেটওয়ার্ক আবিষ্কারের দিকে নিয়ে যায়।
ধরেন, আপনি একটা জিনিস মনে করার চেষ্টা করছেন—একটা সিনেমার নাম। নামটা ভুলে গেছেন, শুধু একটু ধারণা আছে, হয়তো “R” দিয়ে শুরু। আপনার মাথার নিউরনগুলো তখন এক ধরনের অ্যাসোসিয়েশন খুঁজে চলেছে, যা আপনাকে সঠিক নামটা মনে করিয়ে দেবে। ঠিক এভাবেই হপফিল্ডের নেটওয়ার্ক কাজ করে। এটি কোনো কাছাকাছি বা বিকৃত ইনপুট পেলে আসল ডেটা পুনরায় তৈরি করতে পারে। এইটা ব্যবহার করেই চ্যাট জিপিটি দিয়ে আপনি ভুল প্রম্পট করেও সঠিক উত্তর রিটার্ন পান।
এই নেটওয়ার্কের মজা হলো, একাধিক প্যাটার্ন একসাথে সংরক্ষণ করা যায়। ধরেন, এই নেটওয়ার্ককে কিছু ইমেজ শিখানো হলো। পরে কোনো বিকৃত বা আংশিক ইমেজ দিলে সেটি আসল ইমেজটি ঠিকঠাক বের করে আনতে পারবে। হপফিল্ড এই পদ্ধতিকে তুলনা করেন একটি ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে, যেখানে উপত্যকার মধ্যে অনেক উচু নিচু জায়গায় বল গড়িয়ে পড়ে, গ্রাভিটির কারণে বলটি গড়িয়ে এমন পয়েন্টে গিয়েই থামে যেখানে বলটি সবচেয়ে বেশী স্ট্যাবল। একইভাবে, নেটওয়ার্কটি ডেটার ভেতরে লুকানো প্যাটার্ন খুঁজে বের করে বেস্ট সলিউশনে পৌঁছায়।
এখন আপনি ভাবছেন, এটা তো নিছক একাডেমিক ব্যাপার, আসল কাজে কী লাভ? আচ্ছা, ভাবুন—আজকের চ্যাটবট বিষেশ করে চ্যাট জিপিটি, ইমেজ রিকগনিশন সিস্টেম, এমনকি আপনার স্মার্টফোনের ট্রান্সলেটর অ্যাপও এই নেটওয়ার্কের ধারণা থেকে তৈরি। তারা কাছাকাছি বা অসম্পূর্ণ ডেটা পেলেও সঠিক ফলাফল দিতে পারে।
জিওফ্রি হিন্টনের বোল্টজম্যান মেশিনেরঃ
অন্যদিকে, জিওফ্রি হিন্টন ছিলেন আরেক অনন্য প্রতিভা। তিনি ভাবতেন, কীভাবে মেশিন মানুষদের মতো শিখতে পারে? মানুষের মাথায় যেমন অভিজ্ঞতা থেকে শিখে তথ্যগুলো ক্লাসিফাই করে, তেমনটাই মেশিন দিয়ে করানো সম্ভব কি না?
তিনি বোল্টজম্যান মেশিন নামে একটি নতুন ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। এখানে তিনি ফিজিক্সের স্ট্যাটিস্টিক্যাল থিওরি ব্যবহার করেন। সহজভাবে বললে, বোল্টজম্যান মেশিন শেখে উদাহরণ দেখে, নির্দেশনা নয়। ধরেন, বোল্টজম্যান মেশিনকে কিছু বিড়ালের ছবি দেখানো হলো, এরপর কোনো নতুন ছবি দিলেও সেটা চেনার ক্ষমতা তার থাকবে, কারণ মেশিনটি আগের উদাহরণ থেকে শিখেছে।
তবে বোল্টজম্যান মেশিনের আসল সাফল্য আসে ২০০৬ সালে, যখন হিন্টন এবং তার দল ডিপ লার্নিংয়ের ভিত্তি তৈরি করেন। তারা একাধিক বোল্টজম্যান মেশিনের লেয়ার দিয়ে এমন একটি সিস্টেম তৈরি করেন যা ছবি চিনতে ও প্যাটার্ন শনাক্ত করতে দক্ষ হয়ে ওঠে। এটাই ছিল ডিপ লার্নিং এর প্রথম ধাপ, যা পরবর্তীতে আজকের AI সিস্টেমগুলোকে চালিত করছে।
কেন এই পুরস্কার?
আপনি এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, AI আর মেশিন লার্নিং যেই বিপ্লবটা ঘটিয়েছে, তার পিছনে জন হপফিল্ড আর জিওফ্রি হিন্টন এর কাজ কত বড় ভূমিকা রেখেছে। তাদের নেটওয়ার্ক আর লার্নিং মডেল আমাদের কম্পিউটারকে চিন্তাশীল বানিয়ে দিয়েছে। আর হ্যাঁ, ফিজিক্সের নোবেল পুরস্কার দেয়ার কারণও স্পষ্ট—তারা ফিজিক্সের মৌলিক ধারণা ব্যবহার করে এমন কিছু তৈরি করেছেন, যা মানুষকে নতুন যুগের প্রযুক্তির দিকে নিয়ে গেছে।
আজকের দিন থেকে, আমরা প্রতিদিনের জীবনে যেখানে AI দেখি, তার পেছনে একটুখানি হলেও এই দুইজন বিজ্ঞানীর অবদানকে মনে রাখি। তাদের কাজ ফিজিক্স, কম্পিউটার সায়েন্স আর নিউরোসায়েন্সকে একজোট করে আমাদের এনে দিয়েছে নতুন এক প্রযুক্তি বিপ্লব।
তো, আপনারা যারা ভাবছিলেন “ফিজিক্সের নোবেল AI তে কেন?”, তাদের জন্য সহজ উত্তর: AI আর ফিজিক্স মিলে এমন কিছু সৃষ্টি করেছে, যা দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে। জন হপফিল্ড আর জিওফ্রি হিন্টন এই সৃষ্টির মূল কারিগরদের মধ্যে অন্যতম!